Ad Code

'ছেঁড়া তার’ নাট্যাংশটিতে ফুলজানের মাতৃসত্তার যে নিগুঢ় পরিচয় প্রকাশিত হয়েছে তা নিজের ভাষায় লেখাে

 'ছেঁড়া তার' নাট্যাংশ অবলম্বনে ফুলজান চরিত্রটি বিশ্লেষণ করাে। 

অথবা 'ছেঁড়া তার’ নাট্যাংশটিতে ফুলজানের মাতৃসত্তার যে নিগুঢ় পরিচয় প্রকাশিত হয়েছে তা নিজের ভাষায় লেখাে।


উত্তর - 

প্রখ্যাত নট ও নাট্যকার তুলসী লাহিড়ী রচিত ‘ছেঁড়া তার' নাট্যাংশের একটি বিশেষ নারী চরিত্র ফুলজান। ফুলের মতােই কোমল নিস্পাপ ফুলজান চরিত্রটি এক ভাগ্যবিড়ম্বিত চরিত্র। শিক্ষাদীক্ষাহীন উত্তরবঙ্গের এক সাধারণ মুসলমান পরিবারের গৃহবধূ সে, সংসারের প্রতি তার গভীর অনুরাগ, স্বামী-পুত্রের সুগভীর ভালােবাসায় ঋদ্ধ অনন্যা নারী চরিত্র ফুলজান। শিক্ষিত চাষি রহিমুদ্দির স্ত্রী ও বছিরের মা হিসেবেই ফুলজান চরিত্রটির নানা দিক বিকশিত ও বিভাসিত। এক হতভাগিনী নারীর জীবনের করুণ কাহিনির প্রতি নাট্যকারের হৃদয়বেদনা উৎসারিত হয়েছে। সহিষ্ণুতা, ধৈর্য, নম্রতা ফুলজান চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। জন্মের পর সে হারিয়েছে বাবা-মা’কে। অবস্থাপন্ন ফুফার ঘরেই সে প্রতিপালিত, রহিমুদ্দির সঙ্গে বিয়ের পরেই সে পেয়েছে স্বামী, পুত্র, সংসার। সংসারেরমায়ার বন্ধনে বন্দিতনারীর জীবনেই নেমে এসেছিল চরম বিপর্যয়ের কালাে মেঘ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং ১৩৫০ বঙ্গাব্দের মন্বন্তর বাংলার গ্রাম্য জীবনে নিয়ে এসেছিল চরম হাহাকার, অধিকাংশ মানুষ অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটাতে বাধ্য হয়েছে। কালােবাজারি মজুতদারদের রক্তপিপাসু লােভাতুর দৃষ্টির আগুনে ছারখার হয়েছে স্নিগ্ধ মায়াময় বাংলার সাধারণ মানুষের পরিবার। মন্বন্তরের নির্মম কষাঘাতে জর্জরিত ফুলজান তার পুত্র বছিরকে নিয়ে তার ফুফার বাড়িতে গিয়েও আশ্রয় পায়নি, তার ফুফা তাদের দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করেছে। বাড়িতে ফিরে এসেছে লজ্জাবনত চিত্তে। একজন নারীর নম্রতা ও লজ্জাশীলতার প্রকাশ পেয়েছে আলােচ্য ঘটনায়। আকালের দিনে নিজের ফুফার বাড়ি থেকে ফিরে আসার পর তার চরিত্রের দৃঢ়তা মুগ্ধ করে। স্বামীর মর্যাদার প্রতি অটুট আস্থা, ফুফার কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে তাই সে রহিমকে বলেছিল। -“হতাশ হন না। কোন কসুর আমরা করছি যে খােদা হামারগুলা মাইরবে।” হতাশাগ্রস্থ স্বামীর প্রতি ফুলজানের এই সংলাপ আমরা বাস্তববুদ্ধি সম্পন্না ঈশ্বরবিশ্বাসী এক নারীর রমনীয় রূপ প্রত্যক্ষ করি। সন্তানবাৎসল্য ফুলজান চরিত্রের একটি বিশেষ দিক। সন্তানের ক্ষুধার জ্বালা তাকে অস্থির করে তুলেছে, তাই জ্ঞাতিশত্রু হাকিমুদ্দির লঙ্গরখানায় সে গিয়েছিল কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় রহিম চৌকিদারির ট্যাক্স দেয় বলেই তারা সেখান থেকেও প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। দুর্ভিক্ষের দিনে সন্তানকে বাঁচাতে কুচক্রী হাকিমুদ্দির বাঁদি হতে, নারীত্বের চরম অবমাননা মাথায় নিতেও পিছপা হয়নি, অত্যন্ত দৃঢ়চিত্তে রহিমকে তাই বলেছিল “বাচ্চাকে বাঁচানাের দায় বাপের চেয়ে মায়ের বেশি।” মাতৃত্বের অবিকল্প মহিমায় জয়ী হতে চেয়েছে ফুলজান। তার এই মাতৃমূর্তি যুগযুগান্তরের চেনা মাতৃত্বকেই মহিমাময় করে। স্বামী রহিম স্ত্রী-পুত্রকে বাঁচানাের দায়েই ফুলজানকে তালাকনামা লিখে দেয়। অবাক বিস্ময়ে স্বামীর দিকে তাকিয়ে থাকে সে, দুর্ভিক্ষের বিভীষিকা দাম্পত্যের সুখময় দিনযাপনের চেনা ছবিকে বিবর্ণ করে দিল। তালাক অপেক্ষা মৃত্যু শ্রেয় বলে বােধ হয় ফুলজানের, তাই সে বলে “তার চায়া মারি ফ্যালাও -মারি ফ্যালাও।” সে কেবলই ভাবতে থাকে এতদিনের গভীর প্রেমের একটা করুণ পরিণতি! তাই যেন প্রেমের সমাধি তীরে দাঁড়িয়ে তার বেদনাময় উচ্চারণ “ঘর আর মাের তাে নয়।” ফুলজান যেন হারিয়ে যায় এক অনিশ্চয়তার অন্ধকারে। এককথায় বলা যায়, প্রেমময়ী নারী চরিত্র ফুলজান। কর্তব্যে সে অবিচল, স্বামীর প্রতি দায়িত্ববােধে অটল, সন্তানস্নেহে অন্ধ, নিদারুণ যন্ত্রণায় নিরুচ্চার এবং অভাব-উপবাসে চরম সহিষ্ণু এক অনন্য নারী চরিত্র।

Post a Comment

0 Comments

Close Menu